রতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে সশস্ত্র কুকি সম্প্রদায়ের হামলা চালানোর পর পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এরপর সহিংসতায় যোগদেয় হিন্দু সংখ্যাগুরু মেইতেই সম্প্রদায়ের লোকজন। সশস্ত্র কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের সহিংসতার মধ্যেই রাজ্যটিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পাহাড় থেকে কৌত্রুক ও পার্শ্ববর্তী কাদাংবন্দের নিচু এলাকা লক্ষ্য করে হামলা করছে সশস্ত্র কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যরা। তাদের হামলায় হতাহতের পাশাপাশি বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়াও ছাত্রদের রাজভবন অভিযানকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে জারি করা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। এর মধ্যেই রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল ছেড়ে আসামের গুয়াহাটিতে গেছেন মণিপুরের গভর্নর লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্য। রাজ্যটিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনার একদিন পর ইম্ফল ছাড়লেন তিনি। গতকাল বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নর্থইস্ট নাউ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল্টিমেটাম শেষ হওয়ার পর ছাত্র এবং তাদের সমর্থকরা রাজভবনের দিকে যাত্রা করার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন। আর সেই ঘটনার একদিন পর বুধবার মণিপুরের গভর্নর লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্য আসামের গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে রাজ্যের রাজধানী ইম্ফল ত্যাগ করেন।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্নাতকোত্তর এবং স্নাতক স্তরের সমস্ত পরীক্ষা স্থগিত করেছে মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়। এক বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি বলেছে, পরীক্ষার পুনঃনির্ধারিত তারিখ শিগগিরই ঘোষণা করা হবে। নর্থইস্ট নাউ বলছে, লক্ষ্মণ প্রসাদ আচার্য মণিপুরের পাশাপাশি আসাম রাজ্যেরও রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। গত মঙ্গলবার রাজভবন অভিমুখে মিছিল করার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। রাজ্যের পুলিশ প্রধান এবং মণিপুর সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টার অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভকারীরা রাজভবনের দিকে মিছিল নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করেছিল। একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে নিরাপত্তা বাহিনীকে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৫৫ জনেরও বেশি ছাত্র আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। অবশ্য ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এনই জানিয়েছিল, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রায় ১০০ জন বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এই ঘটনার পর রাজ্যপাল আচার্য একই রাতে ছাত্র প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেন। এদিকে মণিপুরে চলমান জাতিগত সংঘাত মোকাবিলায় দেশটির কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর (সিআরপিএফ) সদস্যদের মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। মণিপুর থেকে আসাম রাইফেলসের দু’টি ব্যাটালিয়ন প্রত্যাহার করে নেয়ার কয়েকদিন পর দেশটির কেন্দ্রীয় সরকার সহিংসতায় বিধ্বস্ত রাজ্যটিতে সিআরপিএফের ২ হাজার সদস্যের দু’টি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন করা হয়েছে।
গণমাধ্যমের তথ্যানুসারে, জম্মু-কাশ্মীর ও উত্তর-পূর্বের অন্যান্য অংশে অপারেশনাল দায়িত্ব পালনের জন্য আসাম রাইফেলসের দুটি ব্যাটালিয়ন মণিপুর থেকে প্রত্যাহারের পর এই পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। নতুন এ দুটি ইউনিটের সব কম্পানিকে (প্রতিটিতে প্রায় ৬টি) সংঘাতকবলিত রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ঘাঁটি তৈরি করেছে। গত বছরের মে মাস থেকে জাতিগত সংঘাতে মণিপুরে এ পর্যন্ত ২০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্য গত ১০ দিনে নিহত হয়েছে অন্তত ১১ জন। জাতিগত এই সংঘাতের জেরে রাজ্যটিতে আগে থেকেই সিআরপিএফের ১৬টি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন ছিল। গত সপ্তাহে তারা ইম্ফল পশ্চিম, ইম্ফল পূর্ব, চুরাচাঁদপুর, ননি, জিরিবাম, কাংপোকপি, বিষ্ণুপুরে অপারেশনাল ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে জানা গেছে। সংঘাতের আগে মণিপুরে সাধারণত সিআরপিএফের ১০ থেকে ১১টি ব্যাটালিয়ন মোতায়েন থাকত। কিন্তু এবার তীব্র সহিংসতার জেরে সেটি ১৮টিতে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। মণিপুরে মোতায়েন কেন্দ্রীয় বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করতে চলেছে মোদি সরকার। মণিপুরে প্রধান ভূমিকা পালন করবে সিআরপিএফ। গত বছরের মে মাসে মেইতেই ও কুকি জনগণের মধ্যে সহিংসতা শুরু হওয়ার পর থেকে বাহিনীর নতুন ইউনিটগুলোকে এ রাজ্যে পাঠানো হয়েছিল। এখন বাহিনীকে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যাতে আরো ভালো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে মণিপুরে। নতুন করে ইম্ফলের কৌত্রুক এলাকায় সশস্ত্র আক্রমণে এক নারীসহ দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন একাধিক ব্যক্তি। অভিযোগ উঠেছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা পাহাড় থেকে কৌত্রুক ও পার্শ্ববর্তী কাদাংবন্দের নিচু এলাকা লক্ষ্য করে হামলা চালায়। হতাহতের পাশাপাশি বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশেই রয়েছে কুকি জনবহুল পার্বত্য জেলা কাংপোকপি। এরপর থেকেই বারবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মণিপুরের পরিস্থিতি। গত সপ্তাহে কুকিরা মইরাংয়ে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে বলে অভিযোগ। এ ঘটনায় এক বেসামরিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এর পাশাপাশি মণিপুরের জিরিবাম জেলায় সহিংসতায় চারজন সন্দেহভাজন সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্য ও এক বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। আসাম সীমান্তবর্তী জিরিবামের মংবুং গ্রামের কাছে ওই হামলা চালানো হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, জিরিবামে মেইতেই সম্প্রদাইয়ের এক প্রবীণ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার পর সহিংসতা আরও ছড়িয়ে পড়ে। ওই এলাকায় এখনো উত্তেজনা রয়েছে ও পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের দাবি, রাজ্যে সাম্প্রতিক হিংসায় অত্যাধুনিক ড্রোন ও আরপিজি (রকেটচালিত বন্দুক) ব্যবহার করা হয়েছে। এ ধরনের অস্ত্র সাধারণত যুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়। সেরাম রোজেশ নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আমার বাড়ি মইরাংয়ে। একটা শান্ত জায়গায় এভাবে হামলা চালানো হয়েছে ভেবেই শিউরে উঠছি। ঘটনায় যার মৃত্যু হয়েছে, তিনি মেইতেইয়ের একজন প্রবীণ সদস্য। তাকে এভাবে প্রাণ দিতে হলো, বিষয়টা খুবই দুঃখের।
পুলিশ সন্দেহ করছে, ওই প্রবীণ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে বোমা বিস্ফোরণে। আর সেটি ছোড়া হয়েছিল সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেমবাম কোইরেঙের বাড়িকে লক্ষ্য করে। গত সপ্তাহে একাধিক জায়গায় একই রকমভাবে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশ জানিয়েছে, ৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মণিপুর রাইফেলসের দুটি ব্যাটালিয়নের অস্ত্রাগার লুট করার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু সেখানে মোতায়েন যৌথ বাহিনী তা প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। হামলাকারীদের রুখতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। একদল হামলাকারী আবার পুলিশের ওপর আক্রমণ চালায়, যাতে দুজন পুলিশকর্মী আহত হন।
এডিটর্স গিল্ড অফ মনিপুরের মহাসচিব ও সিনিয়র সাংবাদিক ওয়াই রূপাচন্দ্র সিং বলছিলেন, গত মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও গুলির শব্দ শোনা গেছে ইম্ফলে। বহু জায়গায় টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের ছোটখাটো সংঘর্ষও হয়েছে একাধিক জায়গায়। তবে সামাজিক মাধ্যমে অনেক ধরণের ভুয়া ভিডিও ছড়াচ্ছে, ভুয়া খবরও ছড়াচ্ছে। যেমন এখানে নাকি স্বাধীনতার দাবিতে মানুষ পথে নেমেছেন। মনিপুরে কোনও স্বাধীনতার দাবি ওঠেনি। বরং মেইতেই আর কুকি দুই গোষ্ঠীই এক ধরনের প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে কারা কত বেশি ভারতের জাতীয় পতাকা ওড়াতে পারে, বলছিলেন রূপাচন্দ্র সিং।
মনিপুর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের আইজি কে কবিব বলেছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ইম্ফল উপত্যকায় বহু বিক্ষোভ হয়েছে। ইম্ফল পূর্ব, বিষ্ণুপুর, কাকচিঙ এবং ইম্ফল পশ্চিমে বিক্ষোভ মিছিলগুলি মূলত শান্তিপূর্ণ ছিল। তবে ইম্ফল পশ্চিমের কয়েকটি এলাকায় বিক্ষোভকারীরা সহিংস হয়ে ওঠেন। কাকোয়া বাজার এলাকার বিক্ষোভে বন্দুকসহ সহিংস পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। উরিপক অঞ্চলের একটি বিক্ষোভে পেট্রল বোমাও ছোঁড়া হয়েছে। ওই ঘটনায় ১০ জন পুলিশ কর্মী আহত হয়েছেন। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অনেক ছাত্র ছিল। তবে যারা আহত হয়েছেন বা ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন উস্কানিদাতাও ছিল। এরা সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাসিন্দা নন, জানিয়েছেন মি. কবিব। কারফিউ জারি হওয়ার পরে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ ফ্ল্যাগ মার্চ চলছে এবং রাজধানী ইম্ফলের রাস্তায় যানবাহন খুবই কম চলছে বলেও জানিয়েছেন মি. সিং।
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়ার কথায়, ভারতে আমরা এরকম হামলা আগে দেখিনি। তবে মনিপুর লাগোয়া মিয়ানমারে সেখানকার বিদ্রোহীরা ড্রোন থেকে নিয়মিতই বোমা হামলা চালিয়ে থাকে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপরে হামলা চালাতে তারা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে আখছার। আর এটাও আমরা জানি যে কুকি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির শিবির রয়েছে মিয়ানমারে, সেখান থেকে তারা নিয়মিতই সরঞ্জাম নিয়ে আসে। মনিপুর আর মিয়ানমারের সীমান্তে অনেক ফাঁকফোকর আছে। আবার মিয়ানমারে চীনের তৈরি সস্তার ড্রোন সহজলভ্য। মনিপুরে যেসব ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলি ওই ধরণেরই ড্রোন। অতএব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কোথা থেকে এই প্রযুক্তি আনা হয়েছে। এতে আমরা মোটেই আশ্চর্য হচ্ছি না, জানাচ্ছিলেন মি. গুলেরিয়া। ড্রোন থেকে বোমা হামলা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয়ভাবে তৈরি একধরণের মিসাইল বা রকেট ব্যবহার করা হয়েছে সাম্প্রতিক সহিংসতায়।
বিএসএফের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া মনে করেন, শুধু নিরাপত্তা বাহিনী দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। মনিপুরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে গেলে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পর্যায়ে তার সমাধান খুঁজতে হবে।

* আন্দোলনের তীব্রতায় ইম্ফল ছেড়েছে রাজ্যের গভর্নর * অতিরিক্ত শক্তি বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার
সহিংসতা হামলায় উত্তপ্ত মনিপুর
- আপলোড সময় : ১২-০৯-২০২৪ ১০:১৫:০১ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৩-০৯-২০২৪ ১২:৪৯:২১ পূর্বাহ্ন


নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ